পৃথ্বীশরাজ কুন্তী: মহিষাদল নিয়ে আমার আগ্রহ বেশ কিছুদিন আগে থেকেই।তাই সেই টানেই বেশ কয়েকবার পা রেখেছি মহিষাদল রাজবাড়ির অন্দরে।চেষ্টা করেছি সেখানকার ইতিহাসকে বেশ কিছুটা জানার।মহিষাদলের নাম করলেই রাজবাড়ির পরেই উঠে আসে প্রাচীন ঐতিহ্যশালী রথযাত্রার কথা।পশ্চিমবঙ্গে মাহেশের রথের পড়েই ঐতিহ্য ও ব্যাপকতার দিক থেকে 'মহিষাদলের রথ' শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম দাবিদার।তাই সেই টানেই মহিষাদলের সাবেকীয়ানার রথযাত্রা দেখতে ছুটে যাওয়া।যদিও রথযাত্রার দিন যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।মহিষাদল শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই পুরানো ও নতুন রাজবাড়ি শত শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ধারাকে সাথে নিয়ে আজও আপনছন্দে দন্ডায়মান।
আর এই রাজপরিবারই মহিষাদল রথের প্রবর্তক।যদিও সূচনাকাল ও প্রবর্তক নিয়ে মতপার্থক্য আছে।কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন গর্গ রাজবংশের অন্যতম রাণী জানকী ১৭৭৬ খ্রিস্টব্দে এই রথযাত্রার প্রবর্তন।যদিও প্রামাণ্য সূত্র অনুসারে ১৮০৪ সালে মহিষাদল রথের সূচনা করেন রাণী জানকীর পোষ্যপুত্র মতিলাল পাঁড়ে(উপাধ্যায়)।দ্বিশতবর্ষ অতিক্রান্ত এই রথযাত্রা বাংলার গৌরবময় সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ হিসাবে আজও সমানভাবে বিবেচিত হয়।বর্তমানের তেরোতলাবিশিষ্ট রথটি গুন্ডিচাবাড়ি থেকে রথতলা পর্যন্ত যাত্রা করে।যদিও সূচনালগ্নে এই রথের তল সংখ্যা বেশি ছিল।রাজা লছমনপ্রসাদ গর্গের ফরাসি বন্ধু মঁসিয়ে পেরু ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে রথযাত্রা পরিদর্শনে আসেন।তিনিই নতুন রথের নকশা তৈরি করেন।সেই রথের মূলকাঠামো আজও অপরিবর্তিত রেখে সংস্কার করা হয়।বর্তমান এই রথের দৈর্ঘ্য ও প্রস্হ ৩২ ফুট।চৌত্রিশটি কাঠের চাকা একলাইনে নেই যাতে দু-চারটি চাকা খারাপ হলেও রথ চলাচলে কোন ব্যাঘাত না ঘটে। চাকাগুলো উচ্চতায় চার ফুট আর বেড় বারো ফুট। চারখণ্ড কাঠ দিয়ে একএকটা চাকা তৈরি। প্রতিবছর অন্তত দুটো করে চাকা মেরামত করা হয়। সমস্ত রথে মোট বাহান্নটি খুঁটি আছে যার মধ্যে চারটে মোটা খুঁটি রথকে ধরে রাখে। চারটে খুঁটির মাঝে আছে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। রথের প্রত্যেক তলের চারিদিকে হেঁটে চলাফেরাও করা যায়।গর্গ বংশের রাজারা বন্যপ্রাণী শিকার যে খুব পছন্দ করতেন তা রাজবাড়ির মধ্যে থাকা 'শিকারকক্ষ'এ প্রবেশ করলেই বোঝা যায়।তাদের রথেও এই ছাপ সুস্পষ্ট।রথের বিভিন্ন অংশে হাতি,ঘোড়া,বাঘ,সিংহ প্রভৃতি পশুর উপর বর্শা হাতে সৈন্য বা নর্তকীদের মিছিল দেখা যায়।প্রথিতযশা গবেষক তারাপদ সাঁতরা এগুলিকে মৃত্যুলতা ভাস্কর্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
দ্বিশতবর্ষ প্রাচীন এই রথে অধিষ্ঠিত হন রাজ বংশের আরাধ্য দেবতা 'মদন গোপাল জীউ'।যদিও সাথে থাকেন জগন্নাথদেব।রথযাত্রার আগের দিন রথের চক্ষুদান হয় যা 'নেত উৎসব' রূপে সুবিদিত।রথের দিন শোভাযাত্রা করে জগন্নাথ দেব, গোপাল জিউ ও শ্রীধর জিউকে নিয়ে এসে রথের ওপরে বসানো হয়।পুরীর রথে টান পড়লেই রাজবাড়ির কেউ পালকি করে এসে রথের রশিতে টান দেন।এগিয়ে চলে মহিষাদলের রথ। আর রথের পুণ্যতিথির দিন থেকেই কাঠামোয় মাটি দেওয়ার কাজ শুরু হয়। শুরু হয়ে যায় বাঙালির আরও এক প্রাণের উৎসব দুর্গাপূজার প্রস্তুতি।
যদিও একসময় রাজবাড়ির নিজস্ব হাতি ছিল। তার পিঠে বসে লাল নিশান দেখিয়ে পথ নির্দেশ করতেন মাহুত। পালকি চড়ে আসতেন রাজবাড়ির সদস্যরা, কামান দেগে সূচনা হত রথযাত্রার। আবার উল্টোরথে গুণ্ডিচাবাড়ি থেকে বিগ্রহ ফিরে এলেও কামান দাগা হত।কিন্তু কালের অমোঘ নিয়মে তা আজ কেবলই ইতিহাসের পাতার স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।রয়ে গেছে অমলীন স্মৃতি রূপে।
বাংলায় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র মেদিনীপুর।অবিভক্ত মেদিনীপুরের মহিষাদলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের আঁচ পরে।১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে বেশকিছু স্বদেশী রথশীর্ষে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর দাবি তোলেন।কিন্তু সেই দাবি না মানায় রথ যাত্রাপথের মাঝেই বন্ধ করে দেওয়া হয় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে।এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ নির্বিচারে মেলায় উপস্থিত মানুষের উপর অত্যাচার চালায়।
পক্ষান্তরে,ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করার সাহস গর্গ পরিবারের না থাকা বেগতিক বুঝে রাজার গড়ে থাকা অন্য একটি ছোট রথ নিয়ে আসা হয়।বিগ্রহ বড় রথ থেকে নামিয়ে সেই রথে স্থাপন করে জগন্নাথদেবকে গুণ্ডিচাবাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। আটদিন পর আবার সেই ছোট রথে করেই জগন্নাথদেব রাজবাড়িতে প্রত্যাবর্তন করেন। বড় রথ পড়েই থাকে একইভাবে। বর্ষা শেষ হলে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পরে রথকে তার পূর্ববর্তী স্থানে ফিরিয়ে আনা হয়।
রথ উপলক্ষে আজও কয়েকশো দোকান বসে।মেলা চলে বেশ কিছুদিন।বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আম,কাঁঠাল,মাদুর,গাছের এই মেলায় ছুটে আসেন।দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্টল থেকে শুরু করে জিলিপি-পাঁপড়-ভুট্টা-বাদাম-মুখোরোচক কিছুই বাদ পড়েনা।মেলার আকর্ষণ হিসাবে থাকে নাগরদোলা,পুতুলনাচ,বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আঁটোসাটো নিরপত্তার ব্যবস্থা করা হয়।মেলা জুড়ে থাকে সিসিটিভির ব্যবস্থা।দুই মেদিনীপুর তো বটেই এর পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী হাওড়া,হুগলী,দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন।
বিভিন্ন কারণে বঙ্গসংস্কৃতির অমূল্য রতনগুলি যখন অবলুপ্তির পথে সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আজও মহিষাদলের সুপ্রাচীন রথযাত্রার আবেদন, গরিমা এবং ঐতিহ্য আজও অমলিন।
বাংলার সুস্থ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই রথযাত্রা বঙ্গসংস্কৃতির ভান্ডারকে কালেকালক্রমে সুসমৃদ্ধ করে এগিয়ে চলুক।অক্ষুণ্ন থাকুক রথচক্র।
★চিত্র:- প্রতিবেদক










No comments:
Post a Comment