Tuesday, July 16, 2019

বাংলার নির্জন বালুকাবেলায় একদিন। এক যাযাবরের চোখে ভিন্ন ভাবনায়


পৃথ্বীশরাজ কুন্তী: কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝে একটু সময় পেলেই দুই ভ্রমণপ্রিয় বন্ধু বেড়িয়ে পড়ি অফবিটের উদ্দেশ্যে।তবে এবারের গন্তব্য কোনো অফবিট ছিল না,ছিল আবালবৃদ্ধবনিতার দাপাদাপির প্রাণকেন্দ্র 'দীঘা'।আসলে দু'জনে চেয়েছিলাম সমুদ্র তীরে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা ঢেউয়ের আসা যাওয়ার খেলা উপভোগ করবো আর নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা ভাগ করব নিজেদের মধ্যে।তারই মাঝে প্রথমদিন সন্ধ্যায় ওল্ড দীঘার কোলাহলমুখর সৈকতে বসে হঠাৎই তাজপুরে যাওয়ার প্ল্যান করলাম।কীভাবে যাবো,কতক্ষণই বা লাগবে এই সমস্ত প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।যাইহোক স্থানীয় কিছু মানুষের থেকে বিস্তারিত জেনে নিলাম।আর সাথে তো গুগল ম্যাপ আছেই।সেইমতো প্রস্তুতি নিয়ে পরদিন সকাল সকাল দুই বন্ধুতে বেড়িয়ে পড়লাম নতুন এক জায়গার উদ্দেশ্যে।ওল্ড দীঘা বাসস্ট্যান্ড থেকে কোলকাতাগামী বাসে রামনগর পেড়িয়ে বালিসাই স্টপেজে নামলাম।তারপর দর কষাকষি করে টোটো রিজার্ভ করলাম সরাসরি তাজপুর বীচে পৌঁছে যেতে।বালিসাই বাসস্ট্যান্ড থেকে তাজপুর ৫.৫ কিমি. রাস্তা।টোটো দীঘা বাইপাস পেরিয়ে তাজপুরের রোড নিল।কার্যত জনশূন্য রাস্তা,দু'ধারে বিশালাকারের জলাশয়ে মাছচাষ হচ্ছে,আর রাস্তার দু'পাশে রঙবেরঙের ফুলের গাছের উপস্থিতি।মাঝখান দিয়ে আপন মহিমায় ছুটে চলেছে টোটো।সত্যিই এ এক মনোরম যাত্রাপথ।দু’ধারে বিস্তৃত খাড়ি আর তার মাঝে মাঝে দু’একটা কুটীর ছবির মতো আঁকা। নোনাজলের সমুদ্রের এত কাছেই যে মিষ্টিজলে মাছ চাষ আর ফিশমিল প্রসেস করা হচ্ছে, সেটা দেখতে বেশ মজা লাগে।কোথাও কোথাও সমুদ্রের জল থেকে তৈরি হচ্ছে লবণ।নগর জীবনের ধূসর জীবনযাত্রা থেকে বেড়িয়ে রঙ বেরঙের কতশত নাম না জানা ফুল আর ঝাউয়ের বাগান উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম তাজপুর  সৈকতে।নির্জন,শান্ত এই বীচে সেভাবে মানুষজন নেই সপ্তাহান্তেও।নেই কোলাহল,নেই মানুষের দাপাদাপি।রয়েছে শুধু অন্তহীন ঢেউ ভাঙার শব্দ আর ঢেউ গোনার অবসর।নীলাভ সমুদ্রে কখনো আলো আবার কখনো বা ছায়া।কখন যে শ্বেতশুভ্র ঢেউয়ের বিন্দু বিন্দু জলকণা স্নেহধারার মতো আপনার পায়ের পাতা ভিজিয়ে আবার নিজ গন্তব্যে ফিরে যাবে টেরই পাবেন না।


জীবন ও সময় উভয়ই আপন ছন্দে গতিশীল। তাই এসব ভাবতে ভাবতে ও তাজপুর সৈকতের অপার সৌন্দর্যকে চাক্ষুষ করতে করতে দুই সুজনে এগিয়ে চললাম জলধা সৈকতের উদ্দেশ্যে।সৈকত ছেড়ে কখনো বা উঠে গেলাম ঝাউবনের গহীনে।ঝাউবনের ভিতর হাঁটা বা সমুদ্রের উপর আদিগন্ত নীল শামিয়ানা।এযেন 'অসময়ের পায়ে পায়ে হাঁটা'।এ এক অনন্য আত্মোপলব্ধি।আবার কখনো বা নেমে এলাম সমুদ্র পারে।সমুদ্রের ধারে এলেই 'আকাশলীনা' বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।কবি জীবনানন্দ দাস বলেছিলেন,'সমুদ্র আর আকাশ যেখানে মিশেছে,সেই হল আকাশলীনা'।ইংরাজিতে যা 'Skyline' হিসাবে পরিচিত।


বীচ জুড়ে লাল কাঁকড়াদের অবাধ বিচরণ হঠাৎই যেন মনে করিয়ে দেয় পৃথিবীটা কেবল মানুষের জন্য নয়,সকলের সমানভাবে বাঁচার অধিকারের কথা।
তাজপুরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই লাল-কাঁকড়া। যেটা কাছাকাছির মধ্যে উদয়পুর সি-বিচেও দেখতে পাওয়া যায়। বাকি বীচে লাল কাঁকড়ার পরিমাণ ক্রমশ কমে আসছে। সম্প্রতি কলকাতার বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লাল কাঁকড়ার সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।


আবার বীচের ধারে সারি সারি পড়ে থাকা সবুজের ধ্বংস স্তূপ কখনো বা মনকে ব্যথিত করে তোলে।ভ্রমণ মানে কেবল ছুটি কাটানো নয়,অজানাকে জানা,অদেখাকে দেখা আর জীবনের প্রাত্যহিক অনুভূতিগুলোকে একটু ভিন্নভাবে অনুভব করা।এসব ভাবতে ভাবতেই জলধা সৈকতে এসে পৌঁছলাম।সমগ্র তাজপুর-জলধা বীচ জুড়ে লাল কাঁকড়াদের লুকোচুরি,সারি সারি নৌকার উপস্থিতি,কিমবা মৎসজীবীদের নিরলস জীবন সংগ্রামের বাস্তবিক চিত্র যেকোনো সমাজ ও প্রকৃতি সচেতন পর্যটকের হৃদয়ে যে দাগ কেটে যাবে তা বলাই যায়।জলধা বীচে কাঠের মাচার উপর তৈরি সমুদ্রঘেঁষা এক অস্থায়ী দোকানে বসে দু'বন্ধুতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হৃদয় বিনিময় করার এমন সুবর্ণ সুযোগ আগে কখনো হয়নি।মত বিনিময় নয়,এ যে হৃদয় বিনিময়,সেই হৃদয় যা আমরা খইয়ে ফেলতে ফেলতে দু'হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছি।জীবন মানে তো হীরের খনি!...হঠাৎই মনে পড়ে গেল কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথাগুলো "অবান্তর স্মৃতির ভেতরে আছে,তোমার মুখ...অশ্রু ঝলোমলো..."।



নিজের জীবনদর্শনকে নিয়ে ভাবার সুযোগ হয়না সেভাবে,যাক ভ্রমণের সুবাদে তাও হল।এরই মাঝে নিজেদের মুঠোফোনে প্রকৃতির নীরব,শান্ত,চিত্তাকর্ষক এইসব জ্যান্ত কোলাজগুলোকে বন্দী করে মেরিন ড্রাইভ ধরে এগিয়ে চললাম চাঁদপুর বীচের উদ্দেশ্যে।মসৃণ মেরিন ড্রাইভ ধরে যাওয়ার অনুভূতি দারুণ।সমুদ্র যেহেতু এখানে তেমন উত্তাল নয়, তাই জোয়ারের সময় জলে নামলেই ঢেউয়ের ঝাপটা মিলবে। তবে জলে না নেমে শুধু পাড়ে বসে থাকলেই সময় কেটে যায়,এতটাই মোহময়ী এই নির্জন বীচগুলো।জলধা থেকে শংকরপুরের মধ্যবর্তী স্থানের একটি বীচ চাঁদপুর।সেভাবে পর্যটক চক্ষুর করাল গ্রাসে বিদ্ধ হয়নি এই নির্জন দিগন্ত বিস্তৃত সৈকত।চলার পথে রাস্তার একদিকে চোখে পড়ল ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র,ছোটো ছোটো খড়ের চালে ছাওয়া কুটীর।আর অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত  বঙ্গোপসাগর।কোথাও বা সারি সারি নারকেল গাছ,কোথাও বা ফণীর দাপটে ক্ষয় হওয়া অংশকে সারানোর কাজ চলছে জোরকদমে।প্রকৃতি আর মানুষের অদ্ভুত এক মেলবন্ধন।মেলবন্ধনের এইসব চিত্র চাক্ষুষ করতে করতে হাঁটতে থাকলাম।পৌঁছে গেলাম শংকরপুর।শংকরপুরে মৎসজীবীদের নৌকার আনাগোনা অনেকটাই বেশি।বীচেই ধারেই চোখে পড়ল সুদৃশ্য পার্ক।গুটিকয়েক মানুষ সমুদ্রস্নানেও নেমেছেন দেখলাম।এসব উপভোগ করতে করতেই কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়।যাক বেলা অনেকটাই গড়িয়ে যাওয়ায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদেরও আবার ফিরতে হবে প্রাত্যহিক জীবনের অভিমুখে।


জীবন মানে ভাঙা গড়ার এক নিরন্তর খেলা।সাগরের ঢেউ যেন প্রাত্যহিক জীবনের সকল গ্লানি ভুলিয়ে দিয়ে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার বিশুদ্ধ অক্সিজেন জোগায়।তাইতো আবারও গন্ডিবদ্ধ জীবনের বাইরে গিয়ে নিজেদের অফবিটের তালিকায় সফলভাবে খোদাই করলাম কয়েকটা নাম 'তাজপুর-জলধা-চাঁদপুর'।অজানাকে জানার,অদেখাকে দেখার এই সুখের উল্লাসকে সাথে নিয়ে নিত্যদিনের ব্যস্ততায় ফেরার তাগিদে শঙ্করপুর থেকে পা বাড়ালাম রামনগরের পথে।

★পথনির্দেশ:-
১)ট্রেনে হাওড়া থেকে রামনগর>টোটোয় বা অটোয় তাজপুর

২)কোলকাতা থেকে দীঘাগামী বাসে বালিসাই>টোটোয় তাজপুর(৫.৫ কিমি.)

★চিত্র:- প্রতিবেদক

No comments:

Post a Comment

হাওড়া শ্যামপুরে বাছরী যুব সংঘে মা সাজবেন রেশমী সুতোর সাজে

অর্পণ দাস:  হাওড়া গ্রামীণ অঞ্চলের শ্যামপুর থানার বাছরী গ্রামের "বাছরী যুব সংঘের" সার্বজনীন দুর্গোৎসবের এবছর ৫৩ তম বর্ষ । বিগত...