Tuesday, July 2, 2019

জগন্নাথ-বলরাম-শুভদ্রা নন, হাওড়া আমতায় রথে চেপে যাত্রা করেন 'দামোদর' দেব!




    পৃথ্বীশরাজ কুন্তী: সারাবিশ্বব্যাপী সাম্প্রদায়িকতা যখন মাথাচাছে,জাতি-ধর্ম-বর্ণকে কেন্দ্র করে চারিদিকে যখন এতো হিংসা-হানাহানি-বিদ্বেষ ঠিক সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আজও আমাদের জীবনে শান্তির শুভবার্তা বহন করে নিয়ে আসে 'রথযাত্রা উৎসব'। নামমাত্র হিন্দুদের উৎসব হলেও রথযাত্রা উৎসবকে কেন্দ্র করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ মিলিত হন স্বতঃস্ফূর্ততার সহিত।রথযাত্রা হয়ে ওঠে এক মহামিলন উৎসব।

হাওড়া জেলার মানচিত্রে একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম 'উদং'।দামোদরের বক্ষ থেকে উত্থিত এই গ্রাম তার শিক্ষা-সংস্কৃতির জন্য প্রাচীনকাল থেকেই সুবিদিত।গ্রামে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে আজ থেকে প্রায় শতাধিক বছর পূর্বে পবিত্র রথযাত্রা উৎসবের সূচনা হয় দাতারাম কাঁড়ারের হাত ধরে।শতবর্ষপ্রাচীন সেই ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা আজও চলেছে তার ছান্দিক গতিতে।


বর্তমানে রথযাত্রার প্রধান সংগঠক শ্যামসুন্দর কাঁড়ার জানান, ঘাটশিলা থেকে প্রায় দু'নৌকা কাঠ আনা হয়েছিল তৎকালীন ৩০ ফুটের রথটি নির্মাণের জন্য।সাতদিন ধরে চলতো এই রথযাত্রা উৎসব।বসত মেলা। পার্শ্ববর্তী ৮-১০ টি গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতার পদধূলিতে কলকাকলি মুখর হয়ে উঠত এই মিলন মেলা প্রাঙ্গণ।রথটি উদং বাজার থেকে উদং মনসাতলা পর্যন্ত টানা হতো। পরবর্তীকালে অবশ্য সময়াভাবে মেলা দু'দিনেই(প্রথম রথ ও উল্টোরথ)সীমাবদ্ধ হয়।তার সাথে সংক্ষিপ্ত হয় রথের যাত্রাপথও।সত্তোর্ধ্ব শ্যামসুন্দর বাবু জানান,এই রথের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল,জগন্নাথ-বলরাম-শুভদ্রা নন,রথে চেপে যাত্রা করেন কাঁড়ার বাড়ির আরাধ্য দেবতা 'দামোদর'।

কথিত আছে,বহু বছর পূর্বে কাঁড়ার বাড়ির পুকুর থেকে পাথর রূপে 'দামোদর' দেবের আবির্ভাব ঘটে।অত্যন্ত জাগ্রত রূপে বিবেচিত এই দেবতা।উদং গ্রামের ঐতিহ্যশালী এই রথযাত্রার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে মূলত হৃষিকেশ কাঁড়ারের হাত ধরে।তবে পুরানো বৃহদাকার শিল্পমন্ডিত কাঠের সুদৃশ্য রথটি বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয়ে গেছে।তবে স্মৃতি হিসাবে র‍য়ে গেছে পুরানো রথের সুবিশাল চাকা ও তার কিছু অংশ।তার স্থলে বিংশ শতকের অন্তিম লগ্নে তৈরি হয় লোহার তৈরি রথ।যেটি উত্তর চব্বিশ পরগণার শ্যামনগর থেকে তৈরি করে আনা হয়েছিল।নতুন রথে স্থান পেয়েছে পুরানো কাঠের রথের সারথি ও গড়ুর। কাঁড়ার বংশের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এগিয়ে চলেছে শতাব্দীপ্রাচীন এই উৎসব।শ্যামসুন্দর বাবু আরও জানান,এই মেলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে,মেলায় যোগদানকারী ব্যবসায়ীদের থেকে কোনো অর্থ নেওয়া হয়না।সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেন কাঁড়ার বংশ।মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল ঢাকঢোল সহযোগে লাঠিখেলা।নওপাড়া ও মহিষামুড়ির পোড়খাওয়া লাঠিয়ালদের খেলা দেখতে বহু উৎসুক মানুষ ভিড় জমাতেন মেলায়।উদং পূর্বপাড়ার কাঁড়ার বাড়ির বহুপ্রাচীন মন্দিরে তিথি অনুসারে দামোদরের পূজার্চনা পর বিকেলে ঢাকঢোল,কীর্তন,পালকি,সহযোগে কাঁড়ার বাড়ির মন্দির থেকে 'দামোদর'-কে রথে আনার এই প্রক্রিয়া সাবেকীয়ানার বিশেষ পরিচয়বহ।তারপর চলে পূজা এবং জিলিপি ও মিষ্টি বিতরণ।তারপর রথের রশিতে টান দেন কয়েকশো মানুষ। তিনটি টানে রথ পৌঁছায় তার নিজ গন্তব্যে।মনোরঞ্জন কাঁড়ার, মদনমোহন কাঁড়ার ও শ্যামসুন্দর কাঁড়ারের হাত ধরে এই রথযাত্রা আমতা থানার অন্যতম সাবেকী রথযাত্রা রূপে জনমানসে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।স্থানীয় বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক অরুণ খাঁয়ের কথায়,রথযাত্রা উৎসবকে কেন্দ্র উদং বাজার ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল দু'দিন আনন্দভূমির রূপ পরিগ্রহ করে। কালের নিয়মে আজ হয়তো সেই আভিজাত্য-গৌরবে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে কিন্তু শতবর্ষ অতিক্রান্ত এই গ্রামীণ রথযাত্রা উৎসব ধর্মীয় উৎসবের ঊর্ধে উঠে সামাজিক মহামিলনোৎসবের রূপ পরিগ্রহ করেছে।স্থানীয় বাসিন্দা ঋতম প্রামাণিক জানান,এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে উদং বাজারে প্রতিবছর প্রায় ৫০-৬০ টি দোকান হয়,জিলিপি-পাঁপড়-খেলনা-মুখোরোচক খাবার-হস্তশিল্প-গাছের পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা।আশপাশের প্রায় ১০-১২ টি গ্রামের হাজার দ'শেক মানুষের উপস্থিতিতে রথযাত্রার এই উৎসব মিলন মেলার রূপ ধারণ করে।প্রশাসনের পক্ষ থেকেও উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়।


রথ টানার পর, সুসজ্জিত পালকিতে চড়ে ঢাক-ঢোল-কীর্তন-আতসবাজি-মশাল সহযোগে কাঁড়ার বাড়ির মন্দিরে যাত্রা করেন আরাধ্য দেবতা 'দামোদর'।তারপর চলে পূজার্চনা,উলটোরথের দিন সান্ধ্যকালীন পূজার্চনার পর দামোদরদেবকে পুকুর কেটে স্নান করার প্রাচীন রীতি আজও প্রচলিত।

এই রথযাত্রা কেবল মানুষের সাথে মানুষের মিলনের প্রতীকই নয়,তার সাথেসাথে বহন করে চলেছে উদং গ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রবহমান ধারাকে।তাইতো আজও স্বমহিমায় গতিশীল শতাব্দীপ্রাচীন এই রথচক্র।

ছবি:- প্রতিবেদক(পূর্ববর্তী বছরের)



No comments:

Post a Comment

হাওড়া শ্যামপুরে বাছরী যুব সংঘে মা সাজবেন রেশমী সুতোর সাজে

অর্পণ দাস:  হাওড়া গ্রামীণ অঞ্চলের শ্যামপুর থানার বাছরী গ্রামের "বাছরী যুব সংঘের" সার্বজনীন দুর্গোৎসবের এবছর ৫৩ তম বর্ষ । বিগত...