রণতোষ মুখোপাধ্যায়:-
দুই জেলা, দুই ভিন্ন চিত্র।
(১) জেলা হূগলি। চূচূঁড়ার স্থানীয় বিধায়ক অসিত মজুমদার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বেআইনি ভাবে ভরাট হয়ে যাওয়া পুকুর খুঁড়ে সেটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
(২) জেলা হাওড়া।রামরাজাতলার স্থানীয় বিধায়ক নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রামমন্দিরের প্রাচীন ঐতিহাসিক পুকুরকে বুজিয়ে তার উপরে গড়ে তুলছেন বেআইনি নির্মাণ!
এলাকায় বিধায়কের প্রভাব এতটাই যে ,রামরাজাতলার বুক থেকে একটুকরো ইতিহাসকে মুছে ফেলা হচ্ছে তা চোখের সামনে দেখেও কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস করেননি। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি "জয় শ্রী রাম"-ধ্বনি নিয়ে যখন রাজ্য রাজনীতি উত্তাল, তখন সুকৌশলে রামের সম্পত্তি(রামরাজাতলার রামঠাকুরের)বেচে কাটমানি খাওয়ার এই প্রচেষ্টা কি তবে রাজ্যের শাসকদলের এক বিধায়কের রাম বিরোধী 'জেহাদ' বিজেপির বিরুদ্ধে?
শাসকদলের সর্বোচ্চ স্তর থেকে যারা বলেন ,'রাম আমাদের দেবতা নয়'-তারা বোধহয় জানেননা হাওড়ার রামরাজাতলায় ২৫০বছরেও বেশি সময় ধরে রামঠাকুরের পুজো হয়ে আসছে।আসলে 'মানুষ ই দেবতা গড়ে তাহার কৃপার পরে হয় দেবমহিমা নির্ভর' তাই দেবতার কোনও বাঙালি-অবাঙালি হয়না।তাই এই রামপুজোর প্রথমদিন হাওড়া ছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে বাড়ির গৃহিণীরা উপোস করে পুজো দিতে আসেন রামরাজাতলার এই রামমন্দিরে।
'রামরাজা মন্দির উন্নয়ন পরিষদ'। স্থানীয় বিধায়ক জটু লাহিড়ী এই উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি।কিন্তু কান পাতলেই শোনা যায়, এই পরিষদের নামের সাথে 'উন্নয়ন' যুক্ত থাকলেও উন্নয়নের বদলে এই কমিটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে নাকি দূর্নীতি।কমিটিতে অনেকে থাকলেও ব-কলমে শেষ কথা বলেন ঐ বিধায়ক-ই।
আসলে সুকৌশলে একটি ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে জনগণের সম্পত্তি দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা কাটমানি খাওয়ার এও এক গভীর চক্রান্ত।
উন্নয়ন মানে কি ? একটি ঐতিহাসিক পুকুরকে বুজিয়ে তার উপরে দোকানঘর বা বহুতল নির্মাণ করা নাকি সেটিকে সুন্দরভাবে সংস্কার করে ইতিহাসকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া!
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যেকটি বিশিষ্ট তীর্থস্থান বা মন্দির আছে একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে সেগুলি সংলগ্ন একটি করে পুকুর আছে। প্রতিটি পুকুরের ই কমবেশি ধর্মীয় মাহাত্ম্য রয়েছে।রামরাজাতলায় রামের যে পুকুরটি বুজিয়ে ফেলা হয়েছে তার গুরুত্বও নেহাত কম নয়।
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সারদা দেবীর পদধূলি পড়েছিল হাওড়ার রামরাজাতলায়।ঐ বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে মা সারদার পানিবসন্ত হয়েছিল।সেরে ওঠার পরে গোলাপ মা এবং যোগীন মা'র সঙ্গে হাওড়ার রামকৃষ্ণপুরে নবগোপাল বাবুর বাসায় আসেন।শোনা যায়,রামমন্দির সংলগ্ন পুকুরে স্নান করে তিনি রামমন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন।
মা সারদার পদধূলি ধন্য পূতপবিত্র সেই পূস্করিণীর সংস্কার করলে মন্দিরে আগত ভক্তরা যেখানে মা সারদার অস্তিত্বের অংশীদার হতে পারতেন সেখানে উন্নয়নের ধামাধারী উন্নয়ন পরিষদ ও পরিষদের সভাপতি আস্ত একটা ঐতিহাসিক পুকুরকেই বুজিয়ে ফেললেন টাকার লোভে?
এও তো এক 'সারদা কেলেঙ্কারি' যেখানে মা সারদার স্মৃতিধন্য পুকুর বুজিয়ে বেআইনি প্রোমোটিং হয়!
শুধুমাত্র ঐতিহাসিক গুরুত্ব নয়, এই পুকুরটির অবস্থানগত গুরুত্বও অপরিসীম।রামরাজাতলার এই রামমন্দিরে রাম পুজোকে কেন্দ্র করে রামনবমী থেকে শুরু হয়ে প্রায় তিন মাস ব্যাপী মেলা বসে। বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার ভক্ত প্রতিদিনই ভিড় জমান এই মন্দিরে। প্রতিদিন দেবতার অন্নভোগেরও আয়োজন হয়। হঠাৎ কোনও কারনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে জলের উৎস ছিল একমাত্র ঐ পুকুরটিই।এর আগে দু-দুবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও বড়সড় বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিল ঐ পুকুর ই।আজ যার কোনও অস্তিত্ব ই নেই। আজ ঐ জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে চোখে পড়বে নির্মীয়মান ইট কাঠ পাথরের জঙ্গল।অথচ পুরসভার খাতায় কলমে সেটি পুকুর।
রামের পুকুর বুজিয়ে নির্মাণের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ জারি করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে হাওড়া পৌরসভা। স্থগিতাদেশ পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়, ২৮নং রামচরণ শেঠ রোডের ঐ নির্দিষ্ট জলাশয়টিকে(রামের পুকুর)নোটিশ পাওয়ার ২১ দিনের মধ্যে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে।নচেৎ ১৭এ পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে ঐ ধারায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুরসভার সেই বিজ্ঞপ্তি টালবাহানার পর গ্ৰহণও করে উন্নয়ন পরিষদ'।২ মে এই বিজ্ঞপ্তি গ্ৰহণ করেন রামরাজা উন্নয়ন পর্ষদের সম্পাদক উদয় চৌধুরী। ২১ দিন কেটে গেছে। আজ ২৪ জুন।দেড় মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত।আগের অবস্থায় কি ফিরেছে মা সারদার স্মৃতিধন্য সেই রাম মন্দিরের পুকুর?------- -চলবে।
বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন(৮৯১০৪৬৩১১৭)








No comments:
Post a Comment