রণতোষ মুখোপাধ্যায়:- চড়কে কেন সন্ন্যাসীরা শরীরে বাণ ফোঁড়েন তা জানতে গেলে আগে জানতে হবে অনিরুদ্ধ আর ঊষার প্রেমের কাহিনী।
কিন্তু কে এই অনিরুদ্ধ? অনিরুদ্ধ হল শ্রী কৃষ্ণের নাতি। কথিত আছে যে এক দিন ঊষার সাথে দেখা করতে এসে অনিরুদ্ধ ধরা পরে যায় হরিবংশের রাজা বাণরাজার কাছে। বাণরাজা ক্রুদ্ধ হয়ে অনিরুদ্ধ কে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে খবর কৃষ্ণের কাছে পৌঁছায় ও কৃষ্ণ তার আগেই সেখানে পৌঁছে সুদর্শন চক্র দিয়ে বাণরাজার হাত কেটে দেয়। বাণরাজ ছিলেন শিবের উপাসক। তিনি শ্রী কৃষ্ণ দ্বারা প্রতিহত হয়ে রক্তাত্ব ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় শিবের কাছে এসে নৃত্য করেন। তাতে শিব খুশী হয়ে বাণকে বর প্রদান করেন, সেই বর অনুযায়ী যদি কোনো শিব ভক্ত বাণের মত শোণিতাপ্লুত কলেবরে ভক্তি নিয়ে, সত্য পরায়ণ হয়ে ও সরলতার সাথে শিবের সামনে নৃত্য পরিবেশন করে তবে সেই ভক্ত শিবের পুত্রত্ব লাভ করবে। এর থেকেই শিবের গাজনের সাথে বাণরাজার নাম অনুযায়ী ‘বাণ ফোঁড়া’ কথাটি জড়িয়ে। তাই এই গাজনের সময় শিব ভক্ত ‘সন্ন্যাসী’ রা নিজেদের শরীরে বাণ দিয়ে ছেদ করেন ও শিবের সামনে নৃত্য করেন।
যেযে গ্রামে চড়ক হয় চড়ক গাছ নামে একটা বিশেষ গাছ থাকে সেই গ্রামে। এই চড়ক গাছটি সারা বছর গ্রামের মধ্যের কোনো এক পুকুরে ডোবানো থাকে। গাজনের দিন এই গাছকে সেখান থেকে তুলে এনে মাটিতে স্থাপন করা হয়। গাছটি এখানে শিবের প্রতীক ও ভূমি হলো পার্বতীর প্রতীক। তাই এই শিবের গাজন এক রকম শিব আর পার্বতীর মিলনের উৎসব।
প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য এবং তাঁর পত্নী বলে কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। চৈত্র মাস থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড প্রখর রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও সুবৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিলেন। গ্রাম্য শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করেই এই উৎসবের অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল একদা।
আরও সহজ করে বললে, যে শিব কে সারা বছর আগলে রাখেন ব্রাহ্মণেরা, গাজনের কদিন সেই শিব সমাজের নিম্ন বর্গের মানুষের হাতে পূজা গ্রহণ করেন। এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই, নেই উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা অবহেলা । এ কদিন সবাই সমান মর্যাদায় সমাসীন। এখানেই শৈব সংস্কৃতির সঠিক উত্তরণ। এই চৈত্র সংক্রান্তিতেই শিব হয়ে ওঠেন প্রকৃত অর্থে গণদেবতা।

No comments:
Post a Comment